বর্ষার আকাশ


       সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। গোধুলি ভাবটা এখনো কাটে নি। আকাশটাও আজ থমকে আছে। অন্যসব দিনের মত সাদা তুলোগুচ্ছ আজ আর অবাধে বিচরণ করছে না। সংখ্যায়ও আজ তারা অনেক কম। যেন ইচ্ছে করেই আজ পরাজিত হয়েছে সৈন্যদলের বিরুদ্ধে। তাদের এ পরাজয় দিগন্তজোড়া পাখিরা মেনে নিতে চায় না। আর তাই সবটা ঢেকে দিতে দিগন্তের মাঝে সুন্দর নকশায় নিজেদের উপস্থাপন করছে।
আসলে তারা নীড়ে ফিরছে...
ঠিক এমন একটা প্রাকৃতিক পরিবেশে রেললাইনের উপর গিটার হাতে বসে আছে আকাশ। আজ তার মনটা ভালো নেই। তাই গিটারে সুর উঠছে না। অকারনেই বর্ষা তার উপর রাগ করেছে।

আরে তার কি দোষ?
সে কি ইচ্ছে করেই...
      থাক এসব নিয়ে আর ভাববো না। যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে আর যা হবে তা ঠিকই হবে। হুম কথাটা গীতার একটা লাইন কোথায় যেন পড়েছিলাম। মনে হয় কোন সাহিত্যের পাতায়।

      ঠিক এসব উড়ো ভাবনার মাঝেই মাথার উপর দিয়ে ফুড়ুৎ করে একটা পাখি উড়ে গেল। আর ভাবনাটাকেও সাথে করে উড়িয়ে নিল। মনের অজান্তেই গিটারের তারে আঙ্গুল চলে গেল...
টু র র র র উউং

'মন ভালো নেই
______বারবার মনে হয়
তুমি পাশে নেই
______ভাবি ধুর ছাঁই
কেন কাটে না সময়
সাতটি রঙে
_____তোমাকে খুঁজে বেড়াই
বৃষ্টি শেষে
_____দেখা না পেলে
বড় অভিমান হয়।'

      বৃষ্টি যদিও হয় নি কিন্তু অভিমান ঠিকই হচ্ছে। আরে আমার কথা একটা বারও মনে পরে না? সারাদিন কাজ আর কাজ। উফফফ যেন দুনিয়াতে কাজ ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। সকাল সন্ধ্যা শুধু কাজ কাজ আর কাজ। আমার তো মনে হয় দুপুরে খাওয়াটাও ঠিক মত করে নি। একে নিয়ে সংসার করবো কিভাবে?
ধুররর্
কি সব ভাবছি!!
আর না। সারাদিন যাই করুক, দিন শেষে কিন্তু আমার কাছেই ফিরে আসে। মানুষটাকে এভাবে কষ্ট দেয়া ঠিক হয় নি। আরে একদিন দুদিন হলে মানতাম, তাই বলে প্রতিদিন?
এই তো সেদিনও তো তাই করল। পইপই করে বললাম ঠিক বিকেল চারটায় আসতে, কিন্তু কে শোনে কার কথা। নবাব জাদা এলেন পাঁচটা বাজিয়ে ২মিনিট পর। তখন মেজাজটা আর কোথায় থাকে? রাগে তার না নিজের মাথার চুলগুলোই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল। তাও যদি দিল্লির রাজ্যটা জয় করে সামনে আসত। ইন্টার ভিউ ফেল করে পুরোটা বিকেল পরেপরে ঘুমিয়ে শেষ মেষ সামনে এসেছিল। মেজাজটা তখন ই ই ইইইই....

      গিটার হাতে রেললাইন ধরে হেটে চলেছে আকাশ। আজ তার কোন অভিযোগ নেই নীলিমার বুকে। কারণ নীলিমা তো নিজেরই। সে অন্যের জ্বালা কি বুঝবে? তার চেয়ে এই ভালো আমিও আর তাকে নিয়ে ভাববো না। দূরে সরে যাবো,,, অনেক দূরে...

      অনেকক্ষণ যাবৎ ফোন করছে না। কি যে করে না? একদম ভাল লাগছে না। আজ মনে হয় একটু বেশীই বলে ফেলছি। চলে আসার সময় চোখ মুছছিল। মনে হয় কাঁদছিল...
      না আমিই ফোন করি। ওর আশায় বসে থাকলে আর হবে না। অনেক ভেবে চিন্তে সিন্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। কল করে অধীর আগ্রহ নিয়ে কান পেতে রয়েছে বর্ষা।
অনেকক্ষণ পর সুমিষ্ট কন্ঠে এক মেয়ে উওর দিল 'এই মুহূর্তে আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে...'
      বেশ কয়েকবার চেষ্টা করল। কিন্তু কথার কোন নড়চড় নেই। কেন না জানি অকারণেই মনটা অস্থির হতে শুরু করল...

       ট্রেনের হুইসেল ক্রমসই বেড়ে চলছে। দূরের এক বাজার থেকে কিছু চিৎকার চেচামেচি আর গুঞ্জন ভেসে আসছে। কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ করার মত কেউ নেই। সব বৃথা আস্বঃফলন ছাড়া কিছুই না। শূন্য আকাশে সব চিৎকারের আর্তনাদ কি সহজেই মিলিয়ে যাচ্ছে
      শুধু কষ্টগুলোই যাচ্ছে না ...

      খুঁজতে খুঁজতে বর্ষা রেল লাইনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ সে খুব ভালো করেই জানে আকাশের মন খুব বেশি খারাপ হলে এখানেই আসে। যতদূর চোখ যায় চেনা জানা মানুষের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। পৃথিবীটা এমনই, আশে পাশে হাজার মানুষ থাকলেও মনের মত একটা মানুষও নেই। হাটতে হাটতে এগিয়ে যাচ্ছে বর্ষা। রেললাইনের নুড়ি পাথরগুলো অকারণেই আজ তার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। বারবার সেন্ডেলে আটকে যাচ্ছে। পা ফেলতেই কষ্ট হচ্ছে। কখন যে উঁচু নিচুর কারণে পা মচকে যায় বলা যায় না। ইতোমধ্যে কয়েকবার পরেও যেতে লাগছিল। তাল সামলে কোন মতে মশার গতিতে এগুতে লাগল।
ট্রেনের হুইসেল পাওয়া যাচ্ছে।
এতক্ষণে সূর্য ডোবা সন্ধ্যার অন্ধকারে পুরো পরিবেশটাই ধোয়াটে হয়ে গেছে। ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না।
ট্রেন ক্রমসই এগিয়ে আসছে। তার ঘুনে ধরা পায়ের ঝিঁকঝিক শব্দটা স্পষ্ট কানে আসছে। সাথে দূরের বাজারের কিছু গুঞ্জন।

      ট্রেনের সামনে কিছু একটার অবয়ব দেখতে পেল বর্ষা। হুম একটা মানুষের অবয়ব। তাঁর কাঁধের গিটারটা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে সে কে...
ট্রেন আরো এগিয়ে এসেছে আর ভাবতে পারল না বর্ষা

      দৌড়োতে লাগল...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন